বিএসইসির তদন্ত প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২৪ অক্টোবর ২০২৪
এজিএম পার্টিসহ বাজার কারসাজি ও অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা সম্প্রতি পুঁজিবাজার ঘিরে আন্দোলনের নেপথ্যে মদদ জোগাচ্ছে। এই চক্র কারসাজিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার বিরোধিতা করছে। তারা যেকোনো মূল্যে বর্তমান কমিশনের সংস্কার কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টিতে মরিয়া। নিজস্ব পর্যবেক্ষণ ও অনুসন্ধান প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরেছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য ওই প্রতিবেদন সম্প্রতি পাঠানো হয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ব্যানারে সংঘটিত বিক্ষোভ আন্দোলনে উপস্থিত ব্যক্তিদের অনেকেই পুঁজিবাজারের প্রকৃত বিনিয়োগকারী নন। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন কারসাজির দায়ে জরিমানার শিকার চক্রের সহযোগী ও অনুসারী। তাদের মাধ্যমে এ আন্দোলন সংঘটিত হচ্ছে। আন্দোলনের নামে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী ব্যক্তিদের কার্যক্রম দুরভিসন্ধিমূলক।
বিগত সময়ের অনিয়ম তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, এক দশকের স্বৈরশাসন ও তাদের স্বেচ্ছাচারিতায় দেশের আর্থিক খাত বিপর্যস্ত। যে কারণে পুঁজিবাজারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। বিভিন্ন গোষ্ঠী প্রভাব খাটিয়ে এই বাজারকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে।
তবে বর্তমান কমিশন বাজারের সার্বিক উন্নয়ন ও সংস্কারের পথ নকশা তৈরির কাজ শুরু করেছে। ইতোমধ্যে ২৫ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক জরিমানা এবং ৬০ বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) হিসাব জব্ধ করেছে। এছাড়া ২৪টি কোম্পানির অনিয়ম, দর বৃদ্ধি এবং বিগত সরকারের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও দেশের আর্থিক খাত ধ্বংসের অন্যতম রূপকার দুই ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের মালিকানাধীন কোম্পানি নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে। গঠন করা হয়েছে একটি অনুসন্ধান ও তদন্ত কমিটি গঠন। কারসাজি নিয়ন্ত্রণে সার্ভিলেন্স সিস্টেম উন্নয়নে বিশ্বব্যাংকের কাছে সহায়তা চাওয়া হয়েছে।
যখন এত বড় সংস্কার কার্যক্রম চলছে ঠিক একই সময়ে পুঁজিবাজার ঘিরে সম্প্রতি একশ্রেণির বিনিয়োগকারী নামে তিনটি কমিটি গঠন, বিএসইসির কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে চেয়ারম্যানকে অবরুদ্ধ করাসহ বিক্ষোভ ও আন্দোলন করছে। আন্দোলনের নামে কারা ভিন্ন পাঁয়তারা করছে এ নিয়ে বিএসইসি এই নিজস্ব অনুসন্ধান ও পর্যবেক্ষণ দিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে ।
অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বাজার কারসাজিবাজদের আইনি প্রক্রিয়ায় আনার উদ্যোগ নিয়েছে বর্তমান কমিশন। ইতোমধ্যে একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠীকে পুঁজিবাজারের ইতিহাসের রের্কড পরিমাণ জরিমানা আরোপ করা হয়। যদিও বিগত সময়ে কারসাজি ও অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা বা শাস্তি আরোপ করা হয়নি।
আন্দোলনের নামে ষড়যন্ত্রের কথা প্রতিবেদনে তুলে ধরে বলা হয়, গত ২৮ সেপ্টেম্বর পুঁজিবাজার নিয়ে নামধারী একশ্রেণির বিনিয়োগকারী সংবাদ সম্মেলন ও পরবর্তীতে রাজধানীর মতিঝিলে মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে। কিন্তু কর্মসূচির পেছনে থাকা ব্যক্তিবর্গ সুস্পষ্ট পুঁজিবাজারের অনিয়মের সঙ্গে জড়িত। এরা স্বার্থান্বেষী মহলের আশীর্বাদপুষ্ট যারা তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো এজিএম এ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মতপ্রকাশে বাধাদানকারী হিসাবে অতীতে নানা সময়ে চিহ্নিত। এছাড়া ‘বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী সম্মিলিত পরিষদ’ নামের একটি সংগঠনের ব্যানারে ১২ দফা দাবি জানানো হয়। কিন্তু যে কোনো দাবি জানানোর একটি প্রক্রিয়া আছে। ওই দাবিগুলোর মধ্যে যেগুলো যৌক্তিক সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য সময়ের প্রয়োজন। অথচ ১২ দফা জানানোর ছয় দিনের মাথায় গত ৩ অক্টোবর ‘পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদ’ ব্যানারে একদল বিনিয়োগকারী নামধারী ব্যক্তি বিএসইসির কার্যালয় ঘেরাও করে চেয়ারম্যানের পদত্যাগ দাবি করে। এতে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন বিএসইসির চেয়ারম্যানসহ সব কর্মকর্তা ও কর্মচারী। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কার্যালয়ের সামনে পুলিশ মোতায়েনসহ আলোচনার জন্য তাদের প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। কিন্তু কোনো সাড়া না দিয়ে বিক্ষোভ চালিয়ে যায় তারা। পরে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে কার্যালয়ের প্রধান ফটকের তালা খুলে দেওয়া হলে বিএসইসির চেয়ারম্যান, কমিশনার ও কর্মকর্তারা অফিস ত্যাগ করেন। এর আগে গত ২ অক্টোবর সকাল সাড়ে ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত মতিঝিলে ডিএসইর পুরাতন ভবনের সামনে মানববন্ধন করেন ‘বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদ’।
ঘটনাগুলোর ধারাবাহিকতা থেকে এটা স্পষ্ট এসব কর্মসূচি ও দাবি একটি বিশেষ মহলের স্বার্থে এবং ইন্ধনে হচ্ছে, যা দেশের অর্থনীতি ও পুঁজিবাজারকে অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা মাত্র।
এছাড়া বিক্ষোভ প্রদর্শনকালে ৪০-৫০ শতাংশ মূলধন খুয়েছেন কিছু বিনিয়োগকারীর এমন তথ্য অবান্তর। এছাড়া ফ্লোর প্রাইজ আরোপ ও সার্কিট ব্রেকার নিুগামিতায় হস্তক্ষেপ একটি সুষ্ঠু বাজারের অন্তরায়। এসব কৌশল সাময়িক পুঁজিরক্ষা হলেও দীর্ঘমেয়াদে তা সুফল বয়ে আনেনি তা বিগত সময়ের অভিজ্ঞতায় প্রমাণিত।
বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণে পদক্ষেপ : প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, জাতীয় টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সঙ্গে বিএসইসি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর বাতিল করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে এনটিএমসির দায়িত্বশীলরা বিনিয়োগকারীর অনলাইন কার্যক্রম ও ভয়েস কল রেকর্ডের ক্ষমতা পেতেন। এছাড়া ৯টি কোম্পানির প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) ও রিপিট আইপিওর (আরপিও) মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহকৃত অর্থ কোথায় ও কীভাবে বিনিয়োগ হয়েছে সেটি পরিদর্শন করা হবে।
কারসাজি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা : ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিলে (এফআরসি) তালিকাভুক্ত হতে না পারায় তিনটি অডিট প্রতিষ্ঠানকে বিএসইসির প্যানেল থেকে বাদ দেওয়া হয়। প্রয়োজনীয় বিধি বিধান পালনে ব্যর্থতার কারণে তালিকাভুক্ত বিভিন্ন ব্যাংকের বন্ড ইস্যুর আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। এছাড়া উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে মূলধন সংগ্রহের শর্তপূরণে ব্যর্থতার কারণে তালিকাভুক্ত বিভিন্ন কোম্পানির মূলধন বাড়াতে নতুন শেয়ার ইস্যুর প্রস্তাব বাতিল করা হয়। আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে বিএসইসি যারা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ঘোষিত লভ্যাংশ দেয়নি। এছাড়া বিনিয়োগকারীদের সমন্বিত গ্রাহক হিসাবে বড় ধরনের ঘাটতি পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বিএসইসির পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্রোকার হাউজের মালিক ও শীর্ষ ব্যক্তিদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।