প্রচলিত আইনে জমি অধিগ্রহণ কেন্দ্র করে সরকারের সঙ্গে কোনো মামলা হলে ক্ষতিপূরণের অর্থ স্থগিত করা হয়। পরে তা নিষ্পত্তি হয় আদালতের রায় মোতাবেক। কিন্তু ৭১২৯ জন জমির মালিকের অধিগ্রহণের পাওনা ৪৭৯২ কোটি টাকা আটকে আছে ঢাকা ও চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে। ১৩ বছর ধরে এ টাকা কোষাগারে পড়ে থাকলেও ভুক্তভোগীদের হাতে পৌঁছেনি। সরকারের এক নথি (নিরীক্ষা) থেকে বেরিয়ে আসছে এসব তথ্য।
দীর্ঘদিন ঝুলে থাকায় অনেকে টাকার আশা ছেড়ে দিয়েছেন। এমন ঘটনার বিষয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ও সঠিক উত্তর দিতে পারেনি।
নথি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০০৬-২০১৯ অর্থবছর পর্যন্ত ঢাকা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে ৪৬টি এলএ কেসের (ভূমি অধিগ্রহণ মামলা) বিপরীতে ৩৯৭৩ জন জমির মালিকের পাওনা প্রায় ৩৯৬৮ কোটি টাকা পড়ে আছে। একই সময়ে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে ৪৮৬০ জন মালিকের ৮২৪ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়নি।
দীর্ঘদিনেও কেন ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে টাকা বিতরণ করা হয়নি এবং টাকা কোথায় আছে সে বিষয়ে যুগান্তর খোঁজ নেয়। ৪ জুলাই বিষয়টি নিয়ে কথা হয় ভূমি সচিব মো. খলিলুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, এ সম্পর্কে কিছুই জানেন না। তার মতে, ক্ষতিপূরণ না পাওয়ার পেছনে অনেকগুলো কারণ থাকে। এর মধ্যে একটি অধিগ্রহণের মূল্য জমির প্রকৃত মূল্য থেকে কম হওয়া। যে কারণে অনেক টাকা নিতে আসেন না। তবে অধিগ্রহণের টাকা দেওয়া বা না দেওয়ার সঠিক ব্যক্তি জেলা প্রশাসক। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক ভালো বলতে পারবেন।
৮ জুলাই বিষয়টি ঢাকা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমানের নজরে আনলে তিনি বিষয়টি না দেখে মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বলেন, এ ফাইলটি সম্পর্কে আমার জানা নেই।
তবে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফকরুজ্জামান মোবাইলে যুগান্তরকে বলেন, ‘সেখানে হয়তো কোনো গ্রাউন্ড আছে। মামলা বা ইনজেনশন আছে বা অন্য কোনো বিষয় থাকতে পারে। মামলা না চললে আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের টাকা দেব না কেন? না দেওয়ার কোনো কারণ নেই। তবে এ রিপোর্ট (অডিট) নিয়ে আমার সন্দেহ আছে, যারা এ রিপোর্ট করেছেন তারা আইনের বিষয় কতটুকু জানে বা আদৌ তারা এ আইনের বিষয়ে জানে কিনা আমার জানা নেই। সরকারের নথিতে উল্লেখ আছে, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে ২০০৭-২০১৯ পর্যন্ত ১৩ বছরে জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত ৪০টি এলএ কেসের টাকা বিতরণ করেনি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি টাকা আটকে আছে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের এলএ কেস-০১ (ক্ষতিগ্রস্ত ২০৬ জন, প্রায় ২০৯ কোটি টাকা)। দ্বিতীয় ২০১৭-১৮ অর্থবছরের এলএ কেস-৭ (ক্ষতিগ্রস্ত ৪৮৯ ও ৯৬ কোটি টাকা)। তৃতীয় ঘটনা ২০১৭-১৮ অর্থবছরের এলএ কেস-০১ (ক্ষতিগ্রস্ত ১০৯ এবং প্রায় ৭৯ কোটি টাকা)।
একই সময়ে ঢাকা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে ৪৬টির মধ্যে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এলএ কেস-২০-এ (ক্ষতিগ্রস্ত-৪৫২ জন ও ১১০৭ কোটি টাকা) সবচেয়ে বেশি অর্থ আটকে আছে। দ্বিতীয় ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এলএ কেস-২৩ (ক্ষতিগ্রস্ত ১৭৬ জন এবং ৯৮৬ কোটি টাকা) এবং তৃতীয় ২০০৭-০৮ অর্থবছরে এলএ কেস-১৩ (ক্ষতিগ্রস্ত ১৫৯ জন এবং ৩১৭ কোটি টাকা)।
এ প্রসঙ্গে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, যাদের জমি অধিগ্রহণ হয়েছে, ক্ষতিপূরণ পাওয়া তাদের অধিকার। সেখান থেকে বঞ্চিত করার অধিকার রাষ্ট্রের নেই। এটি উদ্দেশ্যমূলক বা অনিচ্ছাকৃত কিনা খতিয়ে দেখা দরকার। যথানিয়মে ন্যায্য প্রাপ্য দেওয়া উচিত। দ্বিতীয় আইন লঙ্ঘনকারীদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
যেসব ঘটনায় অধিগ্রহণের টাকা বিতরণ হয়নি : ঢাকা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে ২০০৬-২০১১ অর্থবছরে ৬টি এলএ কেসের বিপরীতে ৫৪২ জনের ৩৬৮ কোটি টাকা আটকে আছে। ২০১২-১৬ অর্থবছরের ১৪টি কেসের বিপরীতে ৯৩০ জনের ৪৩৮ কোটি টাকা। ২০১৫-১৮ অর্থবছরে ৩০টির বিপরীতে ১৪৬১ জনের ৭০৩ কোটি টাকা এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৬টি এলএ কেসের বিপরীতে ১০৯৬ জনের ৪৪০ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়নি।
চট্টগ্রাম জেলা কমিশনার কার্যালয়ে ২০০৭-২০১৬ অর্থবছর পর্যন্ত ১৫টি এলএ কেসের বিপরীতে ৮৫২ জনের ৭০ কোটি, ২০১৬-১৯ অর্থবছর পর্যন্ত ২৩টির বিপরীতে ২২৮৭ জনের ৭৫৪ কোটি টাকা বিতরণ হয়নি।
এ বিষয়ে রোববার ঢাকা জেলার এলএ বিভাগের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক পারভেজ চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, জমির কাগজপত্রের ত্রুটি, ওয়ারিস সমস্যা ও মালিকের মৃত্যুসহ নানা কারণে জমির অধিগ্রহণের টাকা পেতে বিলম্ব হয়। এসব সমস্যা সৃষ্টি হলে সংশ্লিষ্টদের শুনানিতে ডেকে সমাধান করা হয়। ২০০৫ সালের ঘটনা এখনো সমাধান হয়নি কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিষয়টি আমার দৃষ্টিতে আনা হয়েছে। আমি এ নিয়ে খতিয়ে দেখব।
জমি অধিগ্রহণ কেন্দ্র করে যত অনিয়ম : ৯ জুলাই দুপুর সাড়ে ১২টা। বৃদ্ধ মাকে নিয়ে নজরুল এবং তার দুই সহোদর মিলে দাঁড়িয়ে আছেন ঢাকা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের এলএ শাখার বারান্দায়। রাজধানীর আবতাফনগর নাসিরাবাদ নন্দিপাড়া মৌজার ২৬ শতাংশের মধ্যে ২০ শতাংশ জমি ২০১৫ সালে অধিগ্রহণ হয়। সাত বছরের বেশি পার হলেও অধিগ্রহণের ২ কোটি টাকা এখন পাননি। শুনানির নামেই দীর্ঘ সময়ে গেছে। এর মধ্যে হয়রানি হচ্ছি, ছোট্ট একটি দোকান সেটি বন্ধ করে আজকে শুনানিতে আসছি। কিন্তু সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তা অনুপস্থিত। যে কারণে আজও ফিরে যেতে হবে। তিনি এখন খিলগাঁওয়ের ত্রিমোহনীতে বাস করছেন।
ভুক্তভোগী মনিরুল হোসেন খান শুনানির জন্য আসছেন মাতুয়াইল যাত্রাবাড়ী থেকে। ২০১৮ সালে ৫ শতাংশ জমি অধিগ্রহণ করলেও এখন পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ পায়নি। আক্ষেপ করে বলেন, সমস্যা সমাধান কে করবে। দিনের পর দিন শুধু ঘুরেই যাচ্ছি। বিভিন্ন অফিসে ধরনা দিতে হচ্ছে। আর পারছি না এভাবে দৌড়াতে। কিন্তু এ শুনানি শেষ কবে হবে, আদৌ টাকা পাব কিনা সেটিও বুঝতে পারছি না।
এদিকে অভিযোগ আছে নিরীহ ভূমি মালিকদের ক্ষতিপূরণের টাকা থেকে কমপক্ষে ১০ শতাংশ না দিলে ফলাফল আসে না। জানা গেছে প্রতিটি জেলায়ই ভূমি মালিকদের হয়রানি একটি সাধারণ ‘ফর্মুলা’ আছে। সর্বশেষ দলিলগ্রহীতা, নামজারি ও দাখিলা প্রদানকারীই হলেন জমির প্রকৃত মালিক। তাকে নোটিশ করলেই ক্ষতিপূরণের বিষয়টি সহজ হয়ে যায়। কিন্তু অধিগ্রহণ শাখা থেকে বিভিন্ন রেকর্ডীয় মালিকের কাছে নোটিশ পাঠিয়ে বিষয়টি জটিল করে তোলা হয়। অনেকেই টাকার লোভে জমির প্রকৃত মালিক না হয়েও একে অন্যের বিরুদ্ধে আপত্তি দায়ের করে। বর্তমান আইনে তখনই ক্ষতিপূরণের টাকা আটকে যায়।
আইনের লঙ্ঘন : জমি অধিগ্রহণে ক্ষতিপূরণের পরিমাণ তিনগুণ করে গত ২০১৭ সালে ১৪ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে ‘স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুমদখল বিল-২০১৭’ বিল পাশ হয়েছে। জমি অধিগ্রহণের টাকা পরিশোধ না করায় এ আইনের উপধারা ১১(১) লঙ্ঘন হয়েছে বলে বাংলাদেশ কম্পোট্রলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের রিপোর্টে মন্তব্য করা হয়েছে। নিরীক্ষা রিপোর্টটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান অডিট অধিদপ্তরের। ৬ জুলাই অধিদপ্তরের পরিচালক মোহাম্মদ শাহ আলম যুগান্তরকে জানান, সারা দেশেই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। অন্যান্য জেলা প্রশাসক কার্যালয়েও এ ধরনের ঘটনা আরও রয়েছে। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের অধীনে আটকে থাকা অর্থ কোথায় আছে সেটিও অনুসন্ধানের দাবি রাখে।