ভারতীয় ঋণে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পের ৭৫ শতাংশ পণ্য ভারত থেকে কেনার মতো কঠিন শর্ত রয়েছে। তা অনুসরণ করতে গিয়ে দেশের অভ্যন্তরে চলমান ভারতীয় ঋণের প্রকল্পগুলো অতিরিক্ত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। পাশাপাশি প্রকল্পের সার্বিক কার্যক্রম বাস্তবায়নে ভারতীয় ঠিকাদার নিয়োগের শর্তও আছে। এতে পর্যাপ্ত ঠিকাদারের অভাব দেখা দিয়েছে। ফলে একদিকে সীমিত ঠিকাদারের অংশগ্রহণ, অন্যদিকে ভারত থেকে পণ্য আনতে গিয়ে প্রকল্পের খরচ বেড়ে যাচ্ছে ৬০ থেকে ৮০ শতাংশ। এছাড়া কাজের প্রতিটি ধাপে অনুমোদনের বাধ্যবাধকতা থাকায় প্রকল্পের অগ্রগতিও আশানুরূপ হচ্ছে না।
সম্প্রতি এসব সমস্যা তুলে ধরে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে ভারতের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনকে চিঠি দিয়েছেন বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে দিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনারের মাধ্যমে এ চিঠি পাঠানো হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
সূত্রমতে, ইন্ডিয়ান ‘লাইন অব ক্রেডিট (এলওসি)’ আওতায় প্রকল্প বাস্তবায়নের বিভিন্ন ইস্যু উঠে আসে ১৭-১৮ জুলাই ভারতের তৃতীয় জি-২০ অর্থমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরদের সম্মেলনেও। গুজরাটের গান্ধীনগরে অনুষ্ঠিত ওই সম্মেলনের সাইডলাইন বৈঠকে ভারতের অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রীর একটি বৈঠক হয়। সেখানে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল উল্লিখিত বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করেন। জানা যায়, ৯ ও ১০ সেপ্টেম্বর ভারতের নয়াদিল্লিতে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অংশ নেওয়ার কথা রয়েছে। ওই সময় বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী প্রত্যাশা করছেন যৌথভাবে আখাউড়া-আগরতলা রেল লিংক প্রকল্প এবং খুলনা-মোংলা রেল সংযোগ প্রকল্পের যৌথ উদ্বোধন করবেন। এ প্রসঙ্গে ভারতের অর্থমন্ত্রীকে দেওয়া চিঠিতে বলা হয়, প্রাথমিক চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও উভয় দেশের যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের পর আখাউড়া-আগরতলা প্রকল্পের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। প্রকল্পের প্রাসঙ্গিক ইস্যুগুলোর দ্রুত সমাধানের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। বিশেষ করে কাস্টমস ডিউটি, ভ্যাটসহ বেশকিছু বিষয় দ্রুত সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় কাজ সম্পন্ন হচ্ছে।
এছাড়া চলমান কিছু প্রকল্পের চ্যালেঞ্জ তুলে ধরে ওই চিঠিতে বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী আরও বলেছেন ভারতীয় ঋণের নির্মাণ প্রকল্পে ৭৫ শতাংশ ভারতীয় সামগ্রী বজায় রাখার শর্তও আমাদের জন্য অতিরিক্ত চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। এছাড়া এলওসি প্রকল্পগুলো অধিকাংশ নির্মাণের জন্য আন্তর্জাতিক মানের মৌলিক উপকরণ যেমন: সিমেন্ট, রড, ইট ব্যবহারের শর্ত দেওয়া হয়। এই উপকরণগুলো ভারত থেকে সংগ্রহ করতে হচ্ছে। অথচ এসব পণ্য বাংলাদেশে স্থানীয়ভাবে পাওয়া যায়। কিন্তু ভারত থেকে পণ্য আনতে গিয়ে প্রায়ই প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়ে দিচ্ছে। যার প্রভাবে কমে গেছে প্রকল্পের অগ্রগতি। ইতোমধ্যে অনেক ভারতীয় ঠিকাদার প্রকল্পের মধ্যে ভারতীয় সামগ্রী কমানোর জন্য অনুরোধ করেছেন।
সেখানে আরও বলা হয়, প্রাথমিকভাবে রেলপথ, সড়ক, শিপিং, স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নের জন্য এলওসির প্রকল্পগুলো নেওয়া হয়। তবে বিভিন্ন সময়ে ঠিকাদারদের অপর্যাপ্ততার কারণে কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেল প্রকল্পের সময়মতো বাস্তবায়নে বিলম্ব হয়েছে। প্রকল্পে ভারতীয় ঠিকাদার নিয়োগের শর্ত রয়েছে। এতে প্রকল্পের দরপত্রের ভারতীয় দরদাতাদের মধ্যেও সীমিত প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে অস্বাভাবিকভাবে উচ্চমূল্যের কারণে পুনরায় দরপত্রের প্রয়োজন হয়।
অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, এটি স্বীকার করা গুরুত্বপূর্ণ যে, এই চুক্তিগুলো সই করার সময় এ প্রকল্পগুলোর একটি সংখ্যার ধারণা ছিল। ফলে প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই, বিস্তারিত নকশা তৈরি, জমি অধিগ্রহণ, ইউটিলিটি স্থানান্তরসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে প্রকল্পগুলো চালু করতে যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন হয়েছিল।
ভারতের অর্থমন্ত্রীকে দেওয়া চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, এলওসি ৫ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ২০ বছরের জন্য মঞ্জুর করা হয়েছিল। এটি লক্ষ করা গুরুত্বপূর্ণ যে, প্রতিটি প্রকল্পের জন্য কোনো স্বতন্ত্র আর্থিক চুক্তি নেই এবং এলওসি চুক্তির মেয়াদ প্রাথমিক বাণিজ্যিক চুক্তির প্রথম বিতরণের তারিখ থেকে শুরু হয়।
প্রসঙ্গত, ২০১০, ২০১৬ ও ২০১৭ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের মধ্যে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় এলওসি চুক্তি স্বাক্ষর হয়। এই চুক্তির আওতায় এক যুগে ভারত প্রায় ৭৩৬ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। এর মধ্যে মাত্র ১৪৯ কোটি ডলারের মতো ছাড় করা হয়েছে। এসব ঋণে সব মিলিয়ে ৪০টি প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা। এসব ঋণের শর্ত হচ্ছে প্রকল্পের ৭৫ শতাংশ কেনাকাটা করতে হবে ভারত থেকে। প্রকল্পের প্রস্তাব থেকে দরপত্র পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে ভারতের এক্সিম ব্যাংকের সম্মতি নিতে হয়। এছাড়া প্রকল্পে ভারতীয় ঠিকাদার নিয়োগ দিতে হবে। এসব কঠিন শর্তের কারণে ইতোমধ্যে ৮টি প্রকল্প প্রত্যাহার হয়েছে। এসব প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ১১৩ কোটি টাকা। প্রত্যাহারের তালিকায় আরও ৪টি প্রকল্প রয়েছে। এসব প্রকল্পের ব্যয় প্রাক্কলন করা হয় ১০১ কোটি টাকা। এছাড়া ভারতীয় ঋণে ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে ১৪টি প্রকল্পের কাজ। বাকিগুলো এখন বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াধীন।
জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ‘গত এক যুগে ভারতীয় ঋণের ছাড় ও প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি বেশ কম। বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দিকেই আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতা ও জটিলতা আছে। নানা নিয়মকানুনের কারণে উভয় পক্ষে সিদ্ধান্ত নিতে অনেক সময় লাগে। আবার ঠিকাদাররা যে দর দেন, তা অনেক বেশি। যেহেতু ভারতীয় ঠিকাদারদেরই কাজ দিতে হবে, তাই বেশি দর দিলেও আমরা তা নিতে বাধ্য। তাতে একধরনের জিম্মি হয়ে যাই।’ জাহিদ হোসেন আরও বলেন, ‘ভারত থেকে ৭৫ শতাংশ কেনাকাটা করে ভৌত প্রকল্প বাস্তবায়ন করা প্রায় অসম্ভব। সার্বিকভাবে ভারতীয় এলওসির অভিজ্ঞতা ভালো নয়। তাই এলওসি থেকে প্রকল্প প্রত্যাহার বা বেরিয়ে আসাকে সমর্থন করি।’