Search
Close this search box.

আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের প্রতিবেদন

 মিজান চৌধুরী

 ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফ-এর যে শর্ত ছিল, তা পূরণ না হওয়ার শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। একইভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপির অঙ্ক ৫৭ হাজার কোটি টাকা নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি ছিল আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের (এফআইডি)। কিন্তু সে প্রতিশ্রুতি ও শর্ত-কোনোটাই পূরণ হয়নি, উলটো এ অঙ্ক গত মার্চ পর্যন্ত ২৭ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে। ফলে খেলাপি ঋণের প্রভাবই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের প্রধান সমস্যা হিসাবে ফের চিহ্নিত করেছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ (এফআইডি)।

এফআইডির ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ‘কর্মসম্পাদন’ প্রতিবেদনে উল্লিখিতসহ আর্থিক খাতে আরও কয়েকটি সমস্যা ও চ্যালেঞ্জের কথা তুলে ধরা হয়। সেখানে বলা হয়েছে, সদ্য বিদায়ি অর্থবছরের জুন পর্যন্ত হিসাবে (সাময়িক) খেলাপি ঋণ কমে আসতে পারে ৬৮ হাজার ২৩০ কোটি টাকায়। সেখান থেকে চলতি অর্থবছরে (২০২৪-২৫) রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপি ঋণের অঙ্ক ৬৪ হাজার কোটিতে নামানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। একই সঙ্গে ২০৩০ সালের মধ্যে খেলাপি হার ১০ শতাংশের ঘরে আনার রোডম্যাপ ঘোষণা দিয়েছে, যা বর্তমানে এই হার ২৪ দশমকি ৮৫ শতাংশে বিরাজ করছে।

এদিকে বাংলাদেশকে আইএমএফ ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ দেওয়ার কয়েকটি শর্তের মধ্যে একটি হচ্ছে ২০২৬ সালের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা। সে শর্ত পূরণে আড়াই বছর হাতে সময় পাচ্ছে সরকার। কিন্তু এই সময়ে খেলাপি ঋণের বিদ্যমান হার (জুনের হিসাব সাময়িক) ২৪.৮৫ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। পাশাপাশি কয়েক বছর ধরেই খেলাপি ঋণের হার ২০ শতাংশের ওপরে বিরাজ করছে। কমিয়ে আনার জন্য প্রতিবছরই প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে এফআইডি। কিন্তু সেটিও সম্ভব হচ্ছে না। সে প্রেক্ষাপটে ২০৩০ সালে এ হার ১০ শতাংশে আনার যে প্রক্ষেপণ, সেটি বাস্তবায়ন নিয়েও শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

প্রসঙ্গত, ব্যাংকিং খাতের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও সুশাসন নিশ্চিত করতে প্রতি অর্থবছরের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সঙ্গে ‘কর্মসম্পাদন’ চুক্তি (এপিএ) স্বাক্ষর করে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। সে ধারাবাহিকতায় ১৫ জুলাই আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ‘কর্মসম্পাদন’ চুক্তি করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সঙ্গে। ওই প্রতিবেদনে খেলাপি ঋণের আধিক্য কমিয়ে এনে ভালো মানের ঋণ বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়া হয়।

খেলাপি ঋণের আধিক্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে বের হয়ে আসছে। মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে বিতরণকৃত ঋণের ১১ দশমিক ১১ শতাংশই খেলাপি হয়েছে। মোট ঋণের অঙ্ক ছিল ১৬ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা, যার মধ্যে ১ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকাই খেলাপি; যা সর্বকালে সবচেয়ে বেশি বলে হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সে হিসাবে জানুয়ারি থেকে মার্চ-এ সময় খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩৬ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা, যা আগের তিন মাসের তুলনায় ২৫ শতাংশ বেশি।

একই সময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ৩ লাখ ১২ হাজার ২৬৬ কোটি টাকার ঋণের মধ্যে খেলাপি অঙ্ক ৮৪ হাজার ৩১১ কোটি টাকা, খেলাপির হার ২৭ শতাংশ। অবলোপনকৃত ও পুনঃতফশিলকৃত ঋণকেও খেলাপির আওতায় এনে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করার কথা বলেছে আইএমএফ। উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশের কারণে হিসাবের বাইরে থাকা ঋণকেও খেলাপি দেখানোর পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি। এসব ঋণকে খেলাপি ধরলে এর অঙ্ক আরও বাড়বে।

জানা যায়, খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে বিভিন্ন সময়ে ব্যবসায়ীদের নানা ছাড় ও সুবিধা দিয়ে আসে বাংলাদেশ ব্যাংক। কোভিড মহামারি এবং পরে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের সময়েও বিশেষ ছাড় দিয়েছিল, এরপরও তা কমেনি। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক মন্দ ঋণ বা খেলাপি ঋণের পুনঃতফশিলের দায়িত্ব কিছু শর্ত রেখে ঋণ প্রদানকারী ব্যাংককেই দেয়। জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাস উদ্দিন যুগান্তরকে জানান, ১৯৯৯ বা ২০০১ সালের হিসাবে ঋণখেলাপ ছিল মাত্র ৪ হাজার কোটি টাকা। এখন পৌনে ২ লাখ কোটি টাকার বেশি। সুতরাং এটি বেড়েই চলবে, যতদিন ঋণখেলাপি শতকরা ২ ভাগ দিয়ে ঋণ পুনঃতফশিলের সুযোগ পাবে আর নিয়মিত গ্রাহক ১০ ভাগ দিয়ে করবে। তিনি মনে করেন, আগে ১০ শতাংশ অর্থ জমা দিয়ে সর্বোচ্চ দুইবার ঋণ পুনঃতফশিল করা যেত। কিন্তু তৃতীয়বার করতে ২০ শতাংশ অর্থ জমা দিতে বিশেষ সুবিধা নেওয়ার বিধান ছিল। আর এখন কেউ কেউ ১০-১২ বার পুনঃতফশিল করছে। যে কারণে খেলাপি ঋণের অঙ্ক বাড়ছে।

সূত্রমতে, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের ‘কর্মসম্পাদন’ প্রতিবেদনে চলতি অর্থবছরের জন্য আর্থিক খাতের বেশি কয়েকটি সূচকের লক্ষ্যমাত্রা নিরূপণ করা হয়। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের পুঞ্জীভূত শ্রেণিকৃত ঋণ থেকে ৩ শতাংশ আদায় করার ঘোষণা দেওয়া হয়। ওই হিসাবে ৬৮ হাজার ২৩০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণের হিসাবে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা হলো ২ হাজার ৪৫ কোটি টাকা। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত অর্থ বিভাগের সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, শ্রেণিকৃত ঋণ থেকে অর্থ আদায়ের যে প্রতিশ্রুতি ব্যাংকগুলো দিয়েছে, বিষয়টি ভালো। কিন্তু ব্যাংকগুলো ঋণ আদায়ে দায়িত্বরত কর্মকর্তারা সঠিকভাবে পালন করছেন কি না, তা ‘ব্যাংক টু ব্যাংক’ ধরে মনিটরিং করা দরকার। এক্ষেত্রে খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের পরিচালকদের ভালো ও দক্ষ কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দিতে হবে। আর যদি এক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়, অবশ্যই ওই কর্মকর্তাকে সেখান থেকে সরিয়ে দিতে হবে।

কর্মসম্পাদন প্রতিবেদনে খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে কৃষকদের মধ্যে ৩৮ হাজার কোটি, শিল্প খাতে ৫ হাজার ৩০০ কোটি এবং এসএমই খাতে ১ লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়। এর মধ্যে এসএমই (নারী) খাতে ১৩ হাজার কোটি টাকার ঋণ দেওয়া হবে।

আর্থিক খাতের প্রধান সমস্যা ও চ্যালেঞ্জের কথা তুলে ধরে প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সরকারি ব্যাংকগুলোয় তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের সমীবদ্ধতা আছে। পাশাপাশি গ্রাহক সেবার ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। গ্রাহক সেবার মান বাড়ানো এবং তথ্যপ্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠাকে চ্যালেঞ্জ হিসাবে শনাক্ত করা হয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আগামী দিনে প্রচলিত ব্যাংক সেবার পাশাপাশি আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর ডিজিটাল ব্যাংক সেবা, বিশেষ করে মোবাইল ব্যাংকিং, ইন্টারনেট ব্যাংকিং ২০৩০ সালের মধ্যে শতভাগ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার রূপরেখা দেওয়া হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *