রাজশাহী গাজী রাইস মিলের কোথায়ও কোনো যন্ত্রপাতি নেই। পড়ে আছে ফাঁকা মাঠ। চোখে পড়ে একটি বয়লার ও চিমনি। আর বয়লিং মেশিন বসানোর জন্য নির্মাণ করা হয়েছিল ইটের গাঁথুনির কয়েকটি পিলার। অটো রাইস মিলের এ প্রকল্পটি চালু করতে পারেননি উদ্যোক্তা। অথচ শুরুতে রাজশাহী গাজী রাইস মিল প্রকল্পের নামে ঋণ নেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল) থেকে। এখন মিলটি পুরোপুরি বন্ধ। একইভাবে খুলনা ক্রিসেন্ট রাইস মিলে শুধু জমি পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে। প্রকল্পটি বন্ধ। এ ধরনের বন্ধসহ দেশব্যাপী ১২৭টি ছোট প্রকল্পের সাফল্য নেই। যারা প্রত্যেকেই ঋণ নিয়েছে বিডিবিএল থেকে। ফলে এসব প্রকল্পের কাছে এখন ১৯২ কোটি টাকাসহ ২৫০ কোটি টাকা আটকে গেছে। বাংলাদেশ কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের (সিএজি) রিপোর্টে উঠে এসেছে এসব তথ্য।
সূত্র জানায়, প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে বিডিবিএল ৫ ধরনের অনিয়ম করেছে। এর মধ্যে ঋণ নীতিমালা ২০১৮ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপন লঙ্ঘন অন্যতম। এছাড়া ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ অনুমোদিত মুঞ্জরিপত্রের শর্তগুলো মানা হয়নি। অর্থ ঋণ আদালত আইন-২০০৩ এবং ব্যাংক কোম্পানি আইন-১৯৯১ লঙ্ঘন হয়েছে। প্রতিবেদনটি পাঠানো হবে সংশ্লিষ্ট সংসদীয় কমিটিতে। কমিটি পর্যালোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী আলমগীর যুগান্তরকে বলেন, নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উঠে আসা ঋণগুলোর অধিকাংশ অবলোপন (রাইট অফ) করা হয়েছে। এগুলো অনেক আগে হয়েছে। আমি এসব রাইট অফ করা ঋণ থেকে টাকা আদায়ের চেষ্টা করছি। তিনি বলেন, টাকা আদায় করতে গিয়ে দেখা গেছে, অনেক ঋণের ক্ষেত্রে কাগজপত্রে ত্রুটি আছে। ঋণ নিয়ে গ্রাহক মারা গেছে। কিছু জটিলতা হচ্ছে। তবে আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর ঋণ দেওয়ার বিষয়ে মনিটরিং করছি। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উঠে আসা ঋণগুলোর সমাধানেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এদিকে বিডিবিএল ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা বিভাগ আছে। বছরের পর বছর অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা হলেও এসব অনিয়ম ধরা পড়ছে না। কেন অনিয়ম ধরা পড়ছে না-এ প্রশ্নের জবাবে বিডিবিএল-এর অডিট কমিটির চেয়ারম্যান মো. এখলাসুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষাব্যবস্থায় দক্ষতার কিছুটা ঘাটতি আছে। যে কারণে অনিয়মের অনেক কিছু উঠে আসে না। তিনি বলেন, দক্ষতা বাড়াতে অভ্যন্তরীণ অডিট বিভাগকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। তাদের মাধ্যমে ব্যাংকের অনিয়মগুলো তুলে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, ১২৭টি প্রকল্পের মধ্যে ঋণ নেওয়ার পর চালু করতে পারেনি ৫১টি। বর্তমানে এগুলো পুরোপুরিই বন্ধ আছে। এসব প্রকল্পের অনুকূলে ব্যাংক ঋণের অঙ্ক ৫২ কোটি টাকা। কিন্তু ঋণের টাকা পরিশোধ না করায় সুদে-আসলে এটি এখন প্রায় ৯৮ কোটিতে পৌঁছেছে। একইভাবে ঋণ নিয়ে পুরোপুরি চালু করতে পারেনি এমন প্রকল্পের সংখ্যাও ৪০টি। এর মধ্যে ২৯টি প্রকল্পই খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। এসব প্রকল্পের অনুকূলে ঋণের টাকা আটকা পড়েছে প্রায় ৪১ কোটি টাকা। আর সুদ-আসলে পৌঁছেছে প্রায় ৫২ কোটিতে। বাকি ৩৬টি প্রকল্পের অনকূলে আটকা আছে প্রায় ১০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে কিছু প্রকল্প চালু থাকলেও অধিকাংশই ঋণখেলাপি।
সূত্র জানায়, ঋণের টাকা নিয়ে চালু করতে না পারা, আংশিক চালু করে খেলাপিতে রূপ নেওয়া-এমন কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রকল্পের সর্বশেষ অবস্থা জানতে সরেজমিন পরিদর্শন করেছে সিএজি প্রতিনিধিদল। সেখানে বলা হয়, খুলনার লামিয়া অটো কোকোনাট অয়েল মিলে কয়েকটি মেশিন অচল অবস্থায় পড়ে আছে। প্রকল্পে স্থাপিত প্রধান মেশিন নেই। সামান্য কিছু অকেজো মেশিন ও লোহা-লক্কড় পড়ে আছে। সেগুলোয় মরিচা পড়ছে। অপর প্রকল্প রংপুরে মিয়া ডেইরি অ্যান্ড পোলট্রি ফার্ম সম্পর্কে বলা হয়, প্রকল্পটি পুরোপুরি ভাঙাচোরা অবস্থায় পাওয়া গেছে। সেখানে কোনো গরু ও মুরগির সন্ধান নেই। পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে প্রকল্পটি। একই অঞ্চলে ভাই ভাই ডেইরি ফার্মের কোনো কার্যকারিতা পাওয়া যায়নি। প্রকল্পটি এখন বন্ধ।
এদিকে রংপুরে ঋণ নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছিল আরেফিন নার্সারি। কিন্তু পরিদর্শনকালে ছোট-বড় গাছের কোনো চারার দেখা মেলেনি। মাঝারি ধরনের কিছু গাছ দেখা গেছে। আর প্রকল্পের ভিটা ও মাঠ পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে। ব্যাংকের তথ্যমতে, রংপুরের মাহাবুবুল ইসলাম ডেইরি ফার্মে ২০টি গাভি ও বাছুর থাকার কথা। ওই হিসাবেই ঋণ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সরেজমিন পরিদর্শনকালে দেখা যায় ৬টি গাভি, কোনো বাছুর নেই।
এছাড়া ভিন্ন চিত্র পাওয়া গেছে মাহসালিম ইস্পাত প্রা. লিমিটেড এবং তাইয়াবা ফুড কারখানায়। দুটি প্রতিষ্ঠানই ব্যাংকের খাতায় খেলাপি। কিন্তু কারখানা দুটি চালু আছে। আর ব্যাংকের খাতা চালু দেখালেও সরেজমিনে অনিকা বয়লার অ্যান্ড অটো রাইস মিল দেখা যায় তালাবদ্ধ অবস্থায় পড়ে আছে।
এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে সিএজি। এতে বলা হয়, বিডিবিএল থেকে ঋণ নিয়ে খেলাপি হওয়ার পরও টাকা আদায়ের জন্য অর্থ ঋণ আদালত আইন-২০০৩-এর ধারা ৪৬ মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এখন দ্রুত মামলা করতে হবে। পাশাপাশি বন্ধ প্রকল্পগুলো থেকে ঋণ আদায়ের ব্যাপারে বিডিবিএলকে আরও তৎপর হতে বলা হয়েছে।