জালিয়াতি ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশ ভেঙে ৩৭টি উৎপাদনমুখী প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন ব্যাংক থেকে রপ্তানি খাতে নগদ সহায়তার ২৪১ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। বিপুল অঙ্কের এ অর্থ ৩৭টি ব্যাংকের ৮৯ শাখার মাধ্যমে বের করে নেওয়া হয়। জালিয়াতির মাধ্যমে অন্য প্রতিষ্ঠানের পণ্য নিজের বলে মিথ্যা ঘোষণা দেওয়া এবং অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে উৎপাদিত পণ্য রপ্তানি দেখানো হয়।
এছাড়া এক দেশে রপ্তানি করে অন্য দেশের প্রত্যাবাসিত মূল্য দেখানোর মতো কারসাজি করা হয়েছে। ২০২৩ সালে উপস্থাপিত সর্বশেষ ২০২১ সালের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উঠে আসছে অনিয়মের এ চিত্র। যদিও উদ্যোগ নিয়ে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আত্মসাতের প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা ফেরত আনা হয়। কিন্তু বাকি ২৩০ কোটি টাকা উদ্ধার সম্ভব হয়নি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
নথির সূত্র ধরে যুগান্তরের পক্ষ থেকে এই অনিয়মের নেপথ্যের কারণ, কারা জড়িত, কীভাবে টাকা তুলে নেওয়া হয়, এর বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা হয়। তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, রপ্তানি খাতের নগদ সহায়তা ঘিরে দুর্নীতি ও অনিয়মের একটি বড় অংশই ঘটেছে বস্ত্র খাতে। এর কারণ হচ্ছে এ খাতে নগদ সহায়তা নিরূপণের জটিল পদ্ধতি। এই সুযোগ নিচ্ছে ব্যাংকের একশ্রেণির কর্মকর্তা ও অসাধু প্রতিষ্ঠানগুলো।
অনিয়ম সম্পর্কে জানতে চাইলে বিকেএমইএ’র নির্বাহী সভাপতি মো. হাতেম যুগান্তরকে বলেন, নগদ সহায়তা সরাসরি প্রত্যাবাসিত রপ্তানি মূল্যের ওপর প্রদান করতে হবে। এটি কার্যকর হলে বর্তমান নগদ সহায়তা নিরূপণের জটিল পদ্ধতি দূর হবে। পাশাপাশি এটি ঘিরে বিভিন্ন পক্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত হচ্ছে সেটিও থাকবে না। তিনি আরও বলেন, রপ্তানি খাতের নগদ সহায়তা ঘিরে যত দুর্নীতি তার মূল কারণ বর্তমান নিরূপণ পদ্ধতি। এতে বিভিন্ন পক্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত হচ্ছে। বঞ্চিত হচ্ছে রপ্তানিকারকরা।
এ প্রসঙ্গে অতিরিক্ত উপমহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক মো. আহসান হাবীব যুগান্তরকে জানান, সবগুলো ব্যাংকের শাখা পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্ভব হয়নি। কারণ আমাদের জনবলের অভাব আছে। এরপরও যাচাই-বাছাইয়ের আওতা বাড়ানো গেলে আরও বেশি অনিয়ম শনাক্ত করা যেত।
অনিয়মের ধরন : অডিট রিপোর্টে বলা হয়েছে, এপেক্স ফুটওয়্যার লি. সিটি ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে শতভাগ পণ্য রপ্তানি না করেই ১৮৬ কোটি ১৭ লাখ টাকা নগদ সহায়তা তুলে নিয়েছে। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বাংলাদেশ বিনিয়োগ বোর্ড (বিডা) থেকে এপেক্স ফুটওয়্যার নিবন্ধন নিয়েছে। সেখানে শর্ত আছে কারখানার উৎপাদিত পণ্য শতভাগ রপ্তানি করতে হবে। কিন্তু সেটি উপেক্ষা করে কোম্পানিটি দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারেও পণ্য বিক্রি করছে।
এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নগদ সহায়তা দেওয়া প্রসঙ্গে এক নির্দেশে বলা আছে-এ সুবিধা পেতে হলে সংশ্লিষ্ট পণ্যটি নিজস্ব প্রতিষ্ঠানে প্রক্রিয়াকরণ ও উৎপাদিত হতে হবে। কিন্তু এপেক্স ফুটওয়্যার নগদ সহায়তা নেওয়ার ক্ষেত্রে এ সংক্রান্ত কোনো প্রমাণপত্র উপস্থাপন করেনি। অপর আরেকটি ঘটনায় একই প্রক্রিয়ায় এপেক্স ফুটওয়্যার কোম্পানি একটি ব্যাংক থেকে তুলে নিয়েছে ৩৬ কোটি টাকা।
অবশ্য নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানকে দি সিটি ব্যাংক গুলশান শাখা একটি জবাব দিয়ে বলেছে, এপ্রেক্স ফুটওয়্যারের রপ্তানি পণ্য স্থানীয়ভাবে উৎপাদনের প্রমাণপত্র দিয়েছে। কিন্তু সর্বশেষ নিরীক্ষা বিভাগ বলেছে, প্রতিষ্ঠানটি প্রস্তুতকৃত পণ্য শতভাগ বিদেশে রপ্তানি করছে এবং অভ্যন্তরীণ বাজারে বিক্রি করছে না এর প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশ রয়েছে রপ্তানি খাতে নগদ সহায়তা পেতে হলে একটি প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত পণ্য শতভাগ রপ্তানি করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে এপেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, এটি গোপন করার কিছু নেই। তবে অডিট রিপোর্টটি সঠিক নয়। এ ঘটনা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে তদন্ত চলছে।
একই রিপোর্টে জালিয়াতির অপর ঘটনা হিসাবে উল্লেখ করা হয়, নগদ সহায়তা পেতে হংকং ও তাইওয়ান থেকে চামড়া রপ্তানির বিপরীতে অগ্রিম টিটির মাধ্যমে পণ্যের মূল্য প্রত্যাবাসিত দেখানো হয়। কিন্তু ওই দুটি দেশে কোনো পণ্য রপ্তানি করা হয়নি। রপ্তানি করা হয়েছে চীন, থাইল্যান্ড ও লাউসে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনায় বলা আছে-রপ্তানিকৃত দেশ ছাড়া ভিন্ন দেশের প্রত্যাবাসিত পণ্য মূল্য দিয়ে নগদ সহায়তা পাওয়া যাবে না। কিন্তু এটি অমান্য করে পূবালী ব্যাংকের খুলনা শাখা থেকে সুপারেক্স লেদার লি. ৫৮ লাখ টাকা তুলে নিয়েছে। এক্ষেত্রে পূবালী ব্যাংকের খুলনা শাখা থেকে বলা হয়, ভিন্ন দেশ থেকে রপ্তানির পণ্যমূল্য প্রত্যাবাসিতকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মানি লন্ডারিং বা অবৈধ হিসাবে গণ্য করে না। এছাড়া রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের চুক্তিপত্রে ভিন্ন দেশ থেকে মূল্য প্রত্যাবাসিত হওয়ার কথা উল্লেখ ছিল। এজন্য এটি গ্রহণ করা হয়েছে।
আরও দেখা গেছে, চট্টগ্রামের তাজরি সি ফুডস ও মেসার্স সিমার্কের (বিডি) রপ্তানিকৃত পণ্য দেশে তৈরির কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। প্রতিষ্ঠানের নামের ওপর চিংড়ি ও অন্যান্য মাছ দেশীয়ভাবে উৎপাদিত ও সংগ্রহ দেখিয়ে চট্টগ্রামের ব্যাংক এশিয়া সিডি শাখা ও আগ্রাবাদ শাখা থেকে নগদ সহায়তার পৌনে তিন কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। একইভাবে অল বাংলাদেশ নামে অস্তিত্বহীন কারখানায় উৎপাদিত পণ্য রপ্তানি দেখিয়ে চট্টগ্রামের ওয়ান ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখা থেকে প্রায় ৭৯ লাখ টাকা তুলে নেওয়া হয়।
অস্তিত্বহীন আরেক প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করে স্কাইনেট সি ফুডস নামে প্রতিষ্ঠান গরু-মহিষের নাড়ি, ভুঁড়ি, শিং ও রগ রপ্তানি দেখিয়ে ৯৪ লাখ টাকা নগদ সহায়তা তুলে নিয়েছে চট্টগ্রামের আন্দারকিল্লার একটি ব্যাংকের শাখা থেকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশ হচ্ছে এ ধরনের পণ্য রপ্তানির বিপরীতে নগদ সহায়তা পেতে স্থানীয় কারখানা থাকতে হবে এবং সেখানে এসব পণ্য উৎপাদন বা সংগ্রহ হয়েছে তার প্রমাণ দাখিল করতে হবে। কিন্তু এক্ষেত্রে কোনোটি প্রতিপালন হয়নি।
অনিয়মের সঙ্গে জড়িত যেসব প্রতিষ্ঠান : নিরীক্ষা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, আনোয়ার ফ্যাশন, লিগ্যাসি ফ্যাশন, ফ্যাশন ওয়ার্চ, এশিয়ান অ্যাপারেলস, আনোয়ার নিটওয়্যার, আনোয়ার কটন, চট্টগ্রাম আগ্রাবাদের ওয়ান ব্যাংক শাখা থেকে প্রায় ১৪ লাখ টাকা অবৈধভাবে তুলে নেয়। উল্লিখিত প্রতিষ্ঠান ছাড়াও আরও যেসব প্রতিষ্ঠান নগদ সহায়তা তুলে নিয়েছে সেগুলো হচ্ছে-গার্ডেনিয়া ওয়্যার্স, মোহাম্মদী ফ্যাশন সোয়েটার, রেফাত গার্মেন্টস, নাবা নিট কম্পোজিট, বিএইচআইএস অ্যাপারেলস, লুমিনাস টেক্সটাইল।
এছাড়া আলীজান জুট মিলস, হাওয়ান অ্যাপারেলস, ইজিস অ্যাপারেলস, কেসি অ্যাপারেলস, দোয়াস লেন্ড অ্যাপারেলস, অ্যাডভান্সড কম্পোজিট টেক্সটাইলস, দি ব্রাদার্স গার্মেন্টস ও নর্দান করপোরেশনের নাম রয়েছে। এ তালিকায় আরও আছে জিএমএস কম্পোজিট নিটিং ইন্ডাস্ট্রিজ, নিলাভো টেকনোলজি, মেসার্স আর্লাইট সিস্টেম, বাংলাদেশ এক্সপোর্ট, ইম্পোর্ট কো. অল বাংলাদেশ, আর্গন ডেনিমস, পেপিলন নিট অ্যাপারেলস, ইন্টারেস্টপ অ্যাপারেল, ফ্লাক্সজেন ড্রেস মার্কেট, হামকো ইন্ডাস্ট্রিজ লি. হবিগঞ্জ এগ্রো।
যে কারণে বাড়ছে নগদ সহায়তা ঘিরে অনিয়ম : দেশের ৪২টি পণ্য রপ্তানিকে উৎসাহিত করতে প্রতিবছর নগদ সহায়তা দিচ্ছে সরকার। তা পাওয়ার শর্ত হচ্ছে দেশীয় উপকরণ দিয়ে উৎপাদিত পণ্য সরাসরি বিদেশে রপ্তানি করা। আর পণ্যের মূল্য প্রত্যাবাসিত হওয়ার ১৮০ দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে আবেদন করতে হয়। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে নগদ সহায়তা নিরূপণ পদ্ধতি জটিলতার কারণেই একে ঘিরে অনিয়ম ও দুর্নীতি বাড়ছে।
সূত্র জানায়, নগদ সহায়তা নিরূপণ পদ্ধতি সংশোধন করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হাফিজুর রহমানকে প্রধান করে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সেখানে অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো, ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কমিটির প্রধান যুগান্তরকে জানান, সরাসরি প্রত্যাবাসিত রপ্তানি মূল্যের ওপর নগদ সহায়তা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
জানা গেছে বর্তমান খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সে সুপারিশ এখন পর্যন্ত কার্যকর হয়নি। তা পড়ে আছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং সেলে। এর কারণ জানতে চাইলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং সেলের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, ২০২৬ সাল থেকে নগদ সহায়তা দেওয়া বন্ধ করবে সরকার। মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছানোর পর রপ্তানি খাতে রুলস অনুযায়ী নগদ সহায়তা দেওয়া যাবে না। যে কারণে বিষয়টি নিয়ে খুব বেশি এগোচ্ছে না মন্ত্রণালয়।
প্রতিবছরই ঘটছে একই অনিয়ম : মূলত নগদ সহায়তা নির্ধারণ সংক্রান্ত জটিল পদ্ধতির কারণে এ খাত ঘিরে গড়ে উঠছে একাধিক চক্র। বর্তমানে ৪২টি রফতানি খাতে সরকার এ সহায়তা দিচ্ছে। এর মধ্যে ২০১৬-২০২০ অর্থবছর পর্যন্ত বাজেটে নগদ সহায়তা বাবদ বরাদ্দ দেওয়া হয় ২০ হাজার ৮২০ কোটি টাকা।
এর মধ্যে বিতরণ হয়েছে ১৯ হাজার ৭৬০ কোটি টাকা। দেশের ৫৬টি ব্যাংকের ১২২৯টি শাখার মাধ্যমে এই টাকা বিতরণ করা হয়। কিন্তু ইতোমধ্যে ৩০টি ব্যাংকের ৮৯টি শাখার তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এর মধ্যেই বিপুল অঙ্কের এই টাকা নয়ছয়ের ঘটনা ধরা পড়েছে। তথ্য সংগ্রহের বাইরে আছে বড় একটি ব্যাংকের বিভিন্ন শাখা। এর আগেও ২০১৩-২০১৭ অর্থবছরে ৭ কোটি টাকা, ২০০৯-১২ অর্থবছরে প্রায় ৭৫ কোটি টাকা, ২০০৬-১০ অর্থবছর পর্যন্ত প্রায় ১০ কোটি টাকা এবং ২০০৫-০৯ অর্থবছর পর্যন্ত ৮৯ কোটি টাকা নয়ছয় হয়েছে।