প্রায় ৪৭ বছর পর আইনের আওতায় আসছে সঞ্চয়পত্র খাত। নতুন আইনের নাম ‘সঞ্চয়পত্র আইন’। এর মাধ্যমে ১১টি স্কিম পরিচালনা করা হবে। নতুন আইনে গুরুত্ব পাচ্ছে পেনশনার ও নারী শ্রেণির ক্রেতা। বর্তমান আইনের বিকল্প হিসাবে বিধিমালার মাধ্যমে সঞ্চয়পত্র বেচাকেনা ও মুনাফা প্রদানসহ সব ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা হচ্ছে। আইনের খসড়া প্রণয়ন করে যাচাই-বাছাইয়ের জন্য পাঠানো হয়েছে মন্ত্রণালয়ে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এ তথ্য।
এদিকে সঞ্চয়পত্র আইনের উদ্যোগের সঙ্গে পথ বন্ধ হচ্ছে ‘সমন্বিত সঞ্চয়পত্র নীতিমালা’। আইন প্রণয়নের আগে প্রথম সিদ্ধান্ত হয়েছিল সঞ্চয়পত্রের জন্য ‘সমন্বিত নীতিমালা’ প্রণয়ন করা হবে। এ জন্য একটি খসড়া তৈরি করে চূড়ান্ত প্রশাসনিক অনুমোদনের জন্য প্রেরণ করা হয় অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে। আর সেটি চূড়ান্ত করতেই অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ এবং সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তরের সঙ্গে একাধিক বৈঠক হয়। যার মাধ্যমে কেটেছে দীর্ঘ পাঁচ বছর। সর্বশেষ তথ্যমতে সেই সমন্বিত নীতিমালা প্রণয়ন থেকে সরে এসে এখন নতুন আইন প্রণয়নের দিকে হাঁটছে অধিদপ্তর।
সূত্রমতে, এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন খোদ অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তীরণ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব আবু হেনা মো. রহমাতুল মনিম। সম্প্রতি অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে জাতীয় সঞ্চয়পত্র স্কিমের জন্য সমন্বিত নীতিমালার বিষয়টি আলোচনায় আসে। বৈঠকে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান নীতিমালার পরিবর্তে নতুন সঞ্চয়পত্র আইন করা হবে। কারণ সঞ্চয়পত্রের কোনো আইন নেই। এরপর সেখানে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব বলেন, ‘সঞ্চয়পত্রের সমন্বিত নীতিমালা তৈরির সিদ্ধান্ত ছিল। এখন সমন্বিত নীতিমালা না করে কেন আইন প্রণয়নের কার্যক্রম গ্রহণ করা হচ্ছে।’ এ বিষয়ে পুনরায় যাচাই-বাছাই করে পরবর্তী সভায় উপস্থাপনের জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন।
সূত্রমতে, ২০১৯ সালে সঞ্চয়পত্রের জন্য একটি সমন্বিত নীতিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। উদ্দেশ্য ছিল এই নীতিমালার আওতায় পরিচালনা করা হবে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের স্কিম। এর খসড়া তৈরি করে অনুমোদনের জন্য জাতীয় সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তর থেকে পাঠানো হয়েছে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে। এই নীতিমালা দ্রুত অনুমোদনের জন্য অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের ক্যাশ অ্যান্ড ডেট ম্যানেজমেন্ট’ কমিটি (সিডিএমসি) বৈঠকে তাগাদা দেওয়া হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই নীতিমালা হচ্ছে না। এখন নতুন আইন প্রণয়ন করা হবে।
এদিকে সঞ্চয়পত্রের নতুন আইন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তরের পরিচালক (আইন) মোহাম্মদ শরীফুল ইসলাম যুগান্তরকে জানান, জাতীয় সঞ্চয় আইন নিয়ে কাজ চলছে। আইনের খসড়া প্রণয়ন করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকে খসড়া আইন যাচাই-বাছাই করছে। সঞ্চয়পত্র আইন প্রণয়ন হলে আরও অনেক কিছু সেখানে পরিষ্কার ব্যাখ্যা থাকবে। এটি বর্তমান সঞ্চয়পত্র বিধিমালা থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী হবে।
প্রসঙ্গত, বর্তমান সব ধরনের সঞ্চয়পত্র ১৯৭৭ সালের বিধিমালা অনুযায়ী পরিচালনা হচ্ছে। এর মধ্যে চারটি সঞ্চয় স্কিম অনলাইন ম্যানেজমেন্টের আওতায় ইস্যু করা হচ্ছে। এগুলো হচ্ছে ৫ বছর মেয়াদি ‘বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র’, ‘তিন মাস অন্তর’ মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র, ‘পরিবার’ সঞ্চয়পত্র এবং ‘পেনশনার’ সঞ্চয়পত্র। উল্লিখিত সঞ্চয়পত্রের মধ্যে ৫ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র এবং তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র পরিচালনা হচ্ছে ‘সঞ্চয়পত্র বিধিমালা-১৯৭৭’-এর মাধ্যমে। এ ছাড়া পরিবার সঞ্চয়পত্র পরিচালিত হচ্ছে ‘পরিবার সঞ্চয়পত্র নীতিমালা-২০০৯ দ্বারা। আর পেনশনার সঞ্চয়পত্র একই ভাবে ‘পেনশনার সঞ্চয়পত্র নীতিমালা-২০০৯’-এর মাধ্যমে পরিচালনা হচ্ছে। আর ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ড বেচাকেনা হচ্ছে ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ড বিধিমালা ২০০২ এবং ইউএস ডলার প্রিমিয়ার বন্ড পরিচালিত হচ্ছে ইউএস ডলার প্রিমিয়ার বন্ড বিধিমালা-২০০২ আলোকে। এ ছাড়া ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ড বিধিমালা-১৯৮১ আলোকে চলছে এ বন্ড বেচাকেনা। এর বাইরে রয়েছে বাংলাদেশ প্রাইজ বন্ড, ডাকঘর সঞ্চয়পত্রের অধীনে সাধারণ হিসাব, মেয়াদি হিসাব, ডাকঘর জীবন বিমা ও অ্যানুইটি। এসব সঞ্চয়স্কিম পৃথকভাবে নীতিমালার মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে গত ৪৭ বছরেও এ খাতে কোনো আইন করা হয়নি। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, ১৯৭৭ সালের বিধিমালাকেই আইনে রূপান্তর করা হচ্ছে। তবে নতুন সঞ্চয়পত্র আইনে আরও স্পষ্টকরণ থাকবে।
সূত্র জানায়, বর্তমানে নারীরা ক্ষমতায়ন ও স্বাবলম্বী হচ্ছে। অনেক নারী আয়ের পথে যুক্ত হচ্ছেন। নতুন আইনে এই নারীদের বেশি করে সঞ্চয়পত্রে সম্পৃক্ত করতে নানা উদ্যোগ থাকছে। এছাড়া প্রকৃত সঞ্চয়পত্রের কেনা বিশেষ করে পেনশনারগণ যাতে কিনতে পারে সে সুযোগ থাকছে। অপরদিকে করপোরেট গ্রুপ, বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কিংবা ধনিক শ্রেণি যাতে এ খাতে অর্থ বিনিয়োগ করতে না পারে আইনে সে ধরনের শর্ত থাকছে। পাশাপাশি বর্তমানে অধিকাংশই সঞ্চয়পত্র বেচাকেনা ও মুনাফা প্রদান অনলাইনভিত্তিক হয়েছে। জাতীয় সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তরের হিসাবমতে আগামী জুন মাসে সব ধরনের ম্যানুয়ালি সঞ্চয়পত্রের মেয়াদ শেষ হবে। ফলে শতভাগ হচ্ছে অনলাইনভিত্তিক। ফলে সবকিছু অটোমেশন হয়ে গেলে নানা ধরনের বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি পেতেই এ আইনটি বেশি প্রয়োজন হবে। নতুন আইনে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের গাইডলাইন থাকবে। ইচ্ছা করলে যে কেউ যে কোনো অঙ্কের সঞ্চয়পত্র কিনতে পারবে না।