স্থানীয় এলসি (ঋণপত্র) জাল করে বেসিক ব্যাংকের উত্তরা শাখা থেকে প্রায় ৮ লাখ মার্কিন ডলারের সমমূল্যের দেশীয় মুদ্রা হাতিয়ে নিয়েছে একটি চক্র। এটি করতে ব্যাংকের ৮৩টি কাল্পনিক গ্রাহকের নামে খোলা হয়েছে এআইডিবি (অ্যাডভান্স এগেইনস্ট ইনল্যান্ড ডকুমেন্টারি বিল) ঋণ হিসাব। এলসি খোলার জন্য নাম ব্যবহার করা হয় শীর্ষ ১০টি ব্যাংকের। ব্যাংকগুলোতে জাল কাগজপত্র পাঠানোর কৌশল নেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবে কোনো বিল বা ডকুমেন্ট সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোতে পাঠানো হয়নি। পুরো জালিয়াতি কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন করতে অস্তিত্বহীন পাঁচটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করা হয়। এ ঘটনার নেপথ্যে কাজ করেছেন ওই শাখার বৈদেশিক বাণিজ্য বিভাগের ইনচার্জ আসাদ মোহাম্মদ ফয়সাল শহীদ। এ ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় তিনি বর্তমানে কারাগারে আছেন। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনা উঠে এসেছে ২০১৯ এবং ২০২০ সালের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে, যা সম্প্রতি দাখিল করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
এলসি বা ঋণপত্র দুধরনের হয়। এর মধ্যে স্থানীয় এলসি হচ্ছে বিদেশে পণ্য রপ্তানির জন্য উৎপাদন পর্যায়ে দেশের ভেতর থেকে কাঁচামাল কিনতে স্থানীয় এলসি খুলতে হয়। উত্তরা শাখায় স্থানীয় এলসি ঘিরেই এ দুর্নীতি হয়েছে। ভয়াবহ এ আর্থিক দুর্নীতির জবাব চেয়ে অডিট বিভাগ চিঠি দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব এবং বেসিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে। জবাব না পেয়ে পুনরায় তাগিদপত্র দেওয়া হয়। এরপরও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। তবে এই জালিয়াতির ঘটনায় বেসিক ব্যাংকের প্রশাসনিক ও অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার দুর্বলতার চিত্র ফুটে উঠেছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
সূত্র জানায় এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত থাকার সন্দেহে চাকরি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে উত্তরা শাখার বৈদেশিক বাণিজ্য বিভাগের ইনচার্জ আসাদ মোহাম্মদ ফয়সাল শহীদ। কিন্তু আত্মসাতের এক টাকাও উদ্ধার হয়নি। যদিও বেসিক ব্যাংকের চাকরি বিধিমালা-২০১৫ এর সপ্তম অধ্যায় এটি অসদাচরণ ও শৃঙ্খলার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এ জালিয়াতির অর্থ আদায়যোগ্য। জানতে চাইলে বেসিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং সিইও মো. আনিসুর রহমান রোববার নিজ কার্যালয়ে বসে যুগান্তরকে জানান, আমার সময় ঘটনাটি ঘটেনি। তবে এ ব্যাপারে একটি মামলা হয়েছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করা হয়। মামলাটি চলমান। এর আগে ২০ জুলাই বৃহস্পতিবার যোগাযোগ করা হলে বেসিক ব্যাংকের উত্তরা শাখার সহকারী মহাব্যবস্থাপক মো. ছাহিদ যুগান্তরকে বলেন, ভুয়া ডকুমেন্ট তৈরি করে এলসির নামে আত্মসাতের টাকা উদ্ধার হয়নি। বৈদেশিক বাণিজ্য বিভাগের ইনর্চাজ ছাড়া অন্য কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, না আর কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এটি নিয়ে ব্যাংকের পক্ষ থেকে একটি মামলা হয়েছে। এখন মামলার রায় অনুযায়ী কাজ হবে।
নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, উত্তরা শাখার বৈদেশিক বাণিজ্য বিভাগের তৎকালীন ইনচার্জ পুরো ঘটনার নেপথ্যে কাজ করেছেন।
জালিয়াতির শুরুতে প্রথম ধাপেই ভুয়া স্থানীয় এলসি খোলার জন্য ব্যাংকের ৫টি গ্রাহককে রপ্তানিকারক হিসাবে দেখান। এরমধ্যে রয়েছে রূপসী এন্টারপ্রাইজ, ইউনিটেক্স বিডি, জ্যাম বাংলাদেশ, জামিল এক্সেসরিজ অ্যান্ড প্যাকেজিং লি. এবং আরএম এক্সেসরিস। এসব গ্রাহকের অনুকূলে পৃথক পৃথক লটে ব্যাংকের মধ্যেই ৮৩টি এআইডিবি ঋণ হিসাব খুলে এই টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
যে ভুয়া স্থানীয় এলসি তৈরি করা হয় এরমধ্যে প্রথম ২০টির নম্বর হচ্ছে-(৩০৫১১৬০৪০০৩০৫, ০৭৫১১৬০৪২৯২৯, ১০২১১৬০৪০-(৫৭১)- (৭৮৫)-(৫৯৬)-(৩৭৩), ০০০৪১৭০৪০০০-(২১)-(১৭৯)-(১৭৪)-(৬২১), ১০৬৬১৫০৪৩৮৮৭, ১০৬৬১৬০৪০৪৪৭৯, ১৩৫০১৬০৪০৩৯৯, ০০৯৩১৬০৪০১৬৭৯, ০৭৫১১৬০৪২-(৭৫৪)-(৮০৩)। এছাড়া আরও ৬৩টি এলসি নম্বর আছে। এ এলসিগুলোর বিপরীতে ভুয়া ডকুমেন্ট তৈরি করা হয়। এরপর প্রথমে কাল্পনিক গ্রাহকের কথিত একাধিক ব্যাংক হিসাবে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পাঠানোর বিষয়ে মিথ্যা ঘোষণাপত্র তৈরি করা হয়। যদিও বাস্তবে এসব ডকুমেন্ট কোনো ব্যাংকেই পাঠানো হয়নি।
এই ঘটনার কয়েকদিন পর কৌশলে দেখানো হয়, যেসব ব্যাংকে এলসি ডকুমেন্ট পাঠানো হয়েছিল সংশ্লিষ্ট ব্যাংক তা গ্রহণ করেছে। এই মর্মে একটি স্বীকারোক্তিপত্রও তৈরি করা হয়। এই এলসিগুলোর বিপরীতে আমদানিকারক হিসাবে দেখানো হয়, এডি ফ্যাশন, এটিএস এ্যাপারেলস, এ প্লাস সুয়েটার, ফলটেক্স কম্পজিটকে।
জালিয়াতির দ্বিতীয় ধাপে গিয়ে রপ্তানিকারক মেসার্স রূপসী এন্টারপ্রাইজের নামে বেসিক ব্যাংকের উত্তরা শাখার বৈদেশিক বাণিজ্য বিভাগের মাধ্যমে ১০টি ‘এআইডিবি’ (অ্যাডভান্স এগেইনস্ট ইনল্যান্ড ডকুমেন্টারি বিল) ঋণ সৃষ্টি করে। পরে এসব ঋণ হিসাবের বিপরীতে ১ লাখ ৯২ হাজার ৩৭৩ মার্কিন ডলার সমমূল্যের দেশি মুদ্রা তুলে নেওয়া হয়। এখানে প্রতিটি এলসির বিল করা হয়েছে ডলারের।
দ্বিতীয় ঘটনায় পৌনে তিন লাখ মার্কিন ডলারের বেশি সমমূল্যের টাকা ভুয়া এলসি ডকুমেন্ট দিয়ে একই কৌশলে তুলে নেওয়া হয়। এই ঘটনায় জ্যাম বাংলাদেশ নামে এক গ্রাহককে রপ্তানিকারক দেখিয়ে ভুয়া স্থানীয় এলসির ডকুমেন্ট তৈরি করা হয়। কথিত ব্যাংকে এসব ডকুমেন্ট পাঠানো হয় বলে মিথ্যা ঘোষণাপত্র তৈরি করা হয়। যদিও বাস্তবে এসব ডকুমেন্টও কোনো ব্যাংকে পাঠানো হয়নি। এক্ষেত্রে কথিত আমদানিকারক হিসাবে দেখানো হয় ফলটেক্স কম্পিজিট লি. এটিএস এ্যাপারেলস, ধরলা ফ্যাশন ও এডি ফ্যাশনকে। এসব আমদানিকারকের বিপরীতে ৩৩ এআইডিবি ঋণ সৃষ্টি করে এই টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। ভুয়া এআইডিবি ঋণগুলো হচ্ছে (৪৪৬, ৪৯২, ৪৯৩, ৫১১, ৫৫৭, ৫৬২, ৫৭৮, ১৩, ২৯, ৪৭৯, ১২, ১২০, ১৫৪, ২২০, ২৫৭, ২৮২, ৩১২, ৩১৩, ৩৪৭, ৪৩৩, ৪৩৪, ৫১৬, ৫৪৭, ১৬, ৬৪, ৮৫, ১৩২, ২০৯, ২৬৫, ৩৩২, ৩৭৪, ৩৭৮, ৩৮৫)। এছাড়া আরও ৫৩টি এআইডিবি ঋণ হিসাব আছে।
এছাড়া ইউনিটেক্স বিডি নামে রপ্তানিকারক সাজিয়ে আরও ২৪টি ভুয়া স্থানীয় এলসির ডকুমেন্ট তৈরি করে হাতিয়ে নেওয়া হয় ২ লাখ ২৩ হাজার ৪৪ ডলার সমমূল্যের অর্থ। এক্ষেত্রে কৌশলে এডি ফ্যাশন নামে একটি ভুয়া আমদানিকারকের নাম ব্যবহার করা হয়। এই একটি আমদানিকারকের অনকূলে ২৪টি ভুয়া বিল তৈরি করে বিভিন্ন ব্যাংকে (এলসি স্থাপনকারী) পাঠানোর কাগজ দেখিয়ে এআইডিবি ঋণ সৃষ্টি করা হয়। এরপর সুকৌশলে এ টাকা বের করা হয়েছে। এছাড়া এক লাখ মার্কিন ডলার সমমূল্যের টাকা তুলে নেওয়া হয় জামিল এক্সেসরিজ অ্যান্ড প্যাকেজিং, আরএম এক্সেসরিজ প্রতিষ্ঠানের নামে রপ্তানিকারক সেজে।
বেসিক ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত বৈদেশিক বিভাগের কর্মকর্তা বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আব্দুল হাই বাচ্চুর নিয়োগকৃত ছিলেন। তবে এই ঘটনায় তিনি জেলহাজতে থাকলেও আত্মসাৎকৃত টাকা আদায় হয়নি।