বেড়েছে পাওয়ার অব অ্যাটর্নির অনুরোধ
প্রতিরোধে কোনো জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি
মিজান চৌধুরী ২৪ আগস্ট ২০২৪
দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত সম্পদের বেশির ভাগই বিক্রি করে সেই অর্থ পাচার করা হয়েছে বিদেশে। যে কারণে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডাসহ বিশ্বের অনেক দেশে বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে সম্পদ বিক্রির জন্য ‘পাওয়ার অব অ্যাটর্নি’ নেওয়ার সংখ্যা বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। মূলত পাওয়ার অব অ্যাটর্নির অনুরোধ বৃদ্ধি পাওয়ার অর্থ হলো-দেশ থেকে সম্পত্তি বিক্রি করে দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। আর ওই অর্থ যে কোনো উপায়ে বিদেশে পাচার করছেন।
বিষয়টি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আঁচ করতে পেরে মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধ সংক্রান্ত জাতীয় সমন্বয় কমিটির ২৭তম বৈঠকে তা অবহিত করে। বৈঠকের কার্যবিবরণী থেকে পাওয়া গেছে এসব তথ্য। তবে অর্থ পাচারের ঘটনা আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, প্রতিরোধে তেমন কোনো জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি ওই সময়।
এদিকে দূতাবাসগুলোয় পাওয়ার অব অ্যাটর্নির অনুরোধের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে দেশের ভেতরে জমি বেচাকেনার নিবন্ধন দলিলের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছিল। নিবন্ধন অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে দলিল নিবন্ধন হয় ৩৪ লাখ ৭৪ হাজার ৬৯৬টি। পরবর্তী অর্থবছরে (২০২১-২২) নিবন্ধনকৃত দলিলের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৫ লাখ ৯৮ হাজার ১৯৭টি। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে মার্চ পর্যন্ত এ সংখ্যা ৩১ লাখ ৩৩ হাজার ৮৪৪টি। অর্থবছর শেষ নাগাদ জুনে সেটি ৩৭ লাখে ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা নিবন্ধন অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্টদের।
প্রসঙ্গত, সারা বছর জমি, ফ্ল্যাট ও বাড়ি কেনাবেচার সময় দলিলের মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন করা হয়। রেজিস্ট্রেশনকৃত দলিলের হিসাব রাখে নিবন্ধন অধিদপ্তর। সরকারের নথিপত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিদেশ থেকে পাচারের অর্থ ফেরত আনতে ২০২২ সালের ৬ ডিসেম্বর মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা এবং নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গঠিত জাতীয় সমন্বয় কমিটির বৈঠক হয়।
সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সভাপতিত্ব করেন। বৈঠকের কার্যবিবরণীতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মাসুদ বিন মোমেন তার বক্তব্যে বলেছেন, ‘ইদানীং বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোয় বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডায় বাংলাদেশিদের কাছ থেকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নির অনুরোধের মাত্রা বহুলাংশে বেড়ে গেছে। এই পাওয়ার অব অ্যাটর্নির অর্থই হচ্ছে বাংলাদেশে এ সম্পত্তিগুলো বিক্রি হচ্ছে এবং যে কোনো উপায়ে ওই অর্থ ওইসব দেশে চলে যাচ্ছে। জমিগুলোর বাজারমূল্যে লেনদেন হলেও রেজিস্ট্রেশন হচ্ছে অনেক কম মূল্যে।’
একই বৈঠকে উপস্থিত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের তৎকালীন সচিব শেখ মোহাম্মদ সলিম উল্লাহ (বর্তমান অবসর) বলেছেন, ‘জমি বিক্রি করে যারা টাকা পাচার করেন, তাদের কাছে জমির দাম কম বা বেশি বিবেচনার চেয়ে অর্থ দেশ থেকে নিয়ে যাওয়াই মুখ্য বিষয়। তবে বিবেচ্য বিষয় হলো, জমি যেন বাজারমূল্যে রেজিস্ট্রেশন করা হয় এবং অর্থ পাচার না হয়।’
সেখানে তৎকালীন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছেন, ‘পাওয়ার অব অ্যাটর্নি বা অন্য কোনো মাধ্যমে সম্পত্তি বিক্রি করে সে অর্থ বিদেশে নিয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ, আমাদের ক্যাপিটাল অ্যাকাউন্ট নন-কনভার্টিবল। সুতরাং জমি বিক্রি করে যারা টাকা নিয়ে যাচ্ছেন, এটা সম্পূর্ণ অবৈধভাবে নিয়ে যাচ্ছেন’।
কিন্তু দেশ থেকে অর্থ পাচারের চাঞ্চল্যকর তথ্য নিয়ে ওই বৈঠকে বিস্তর তুলে ধরা হলেও প্রতিরোধে পদক্ষেপ ছিল আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কমিটির সভাপতি আ হ ম মুস্তফা কামাল পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনতে সরকারের প্রণয়নকৃত ‘কর্মকৌশলপত্র’ বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে নির্দেশনা দিয়েই বৈঠক শেষে করেন। এরপর গত দুই বছরে পাচার প্রতিরোধ সংক্রান্ত জাতীয় সমন্বয় কমিটির আর কোনো বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়নি।
সর্বশেষ ১৪ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ অর্থ পাচার প্রতিরোধ সংক্রান্ত জাতীয় সমন্বয় কমিটির বৈঠক করেছেন। কমিটির প্রধান হিসাবে তিনি জানান, অর্থ পাচারের ব্যাপারে গত দুই বছরে অনেক পদক্ষেপ ঝুলে ছিল। সংশ্লিষ্ট অনেক মন্ত্রণালয় ও বিভাগ আছে। তারা সবাই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। অন্তত সরকারের পক্ষ থেকে যার যার জায়গা থেকে এ সংক্রান্ত পদক্ষেপ এগিয়ে নিতে আরও সক্রিয় হওয়ার কথা বলা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, যারা বিদেশে অর্থ পাচার করেছে, তাদের কিছু ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হচ্ছে। পরবর্তী সময়ে আরও করা হবে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, আওয়ামী লীগ সরকার বিভিন্ন সময়ে কালোটাকা সাদা করার পথ হিসাবে বিনা প্রশ্নে জমি, বাড়ি ও ফ্ল্যাটে বিনিয়োগের সুযোগ করে দেয়। এ সুযোগ নিয়ে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ দিয়ে একশ্রেণির অসাধু ব্যক্তিরা দেশের ভেতর প্রথমে স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি গড়ে তুলেন। পরে সময়-সুযোগ অনুযায়ী ওই সম্পদ বিক্রির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ বিদেশে পাচার করেন। তবে ২০২৩ সালের শুরুতে এসব ঘটনা বেশি ঘটেছিল। যে কারণে ওই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডাসহ বিশ্বের অনেক দেশে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোয় পাওয়ার অব অ্যাটর্নির আবেদনের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।
যদিও আওয়ামী লীগ সরকারের সময় পাচারের অর্থ ফেরত আনতে একটি কৌশলপত্র প্রণয়ন করা হয়। সেখানে ১০টি দেশে বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচার হচ্ছে বলে উল্লেখ করা হয়। দেশগুলো হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, কেম্যান আইল্যান্ড ও ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডস।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) সাবেক উপদেষ্টা দেব প্রসাদ দেবনাথ যুগান্তরকে জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর অ্যাসেট রিকভারি ইউনিট করার ঘোষণা দিয়েছেন। এটি হলে বিদেশ থেকে টাকা ফেরত আনার কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হবে। তিনি আরও বলেন, এ টাকা উদ্ধার করতে গেলে সরকারের প্রতিশ্রুতি, একটি কার্যকরী উইং এবং আইনগত সহায়তা ও পলিসি সহায়তা দরকার হবে। তাহলে বিদেশ থেকে দ্রুত টাকা ফেরত আনা সম্ভব হবে।
মিজান চেৌধুরী